শব্দের পোস্টমর্টেম-১০৭
অনুস্বর (ং) আর অনুস্বারের (ং) মাঝে কোনটি শুদ্ধ আর কোনটি অশুদ্ধ তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক রয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে দুটিই শুদ্ধ এবং ব্যাকরণসম্মত। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অনুস্বরকেই শুদ্ধ মনে হতে পারে। অনুস্বরের গঠন হচ্ছে 'অনু + স্বৃ + অ(অল)'।
অন্যদিকে অনুস্বারের গঠন হচ্ছে 'অনু + স্ব + অ(ঘঞ)'।
অনুস্বরের পক্ষে ছিলেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বিবেচনায় অনুস্বার অশুদ্ধ। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বিবেচনায় দুটিই শুদ্ধ।
সুভাষ ভট্টাচার্য তাঁর 'বাংলা প্রয়োগ অভিধান'-এ লিখেছেন, 'কেউ কেউ ঋগ্বেদ, প্রাতিসাখ্য এবং পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর প্রয়োগ অনুসরণ করে অনুস্বার শব্দটিকেই শুধু ব্যবহার্য বলেন।'
বাংলায় অনুস্বার শব্দটি বেশ পুরনো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়রা অনুস্বারের পক্ষে ছিলেন।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর 'বাঙ্গালা বানান সমস্যা' প্রবন্ধে অনুস্বারই লিখেছেন। তার মতে, 'আমরা বলিব, সরলতার জন্য বাঙ্গায় কেবল অনুস্বারই চালান উচিত')। বোঝা যাচ্ছে, অনুস্বরের পাল্লা সে তুলনায় ভারি নয়।
শব্দের পোস্টমর্টেম-১০৮
অন্তর নিয়ে আমরা নিত্য টানাপোড়েনে থাকি। শব্দটির রয়েছে নানা রূপ, নানা আবেদন এবং নানামুখী প্রয়োগ।
অন্তর বেদে ব্যবহৃত শব্দ। সংস্কৃতে এটার রয়েছে নানা অর্থ। মধ্যবর্তী (তুলনীয় আবস্তায় anantara, লাতিনে inter, গথিকে anthar, ইংরেজিতে interior )আত্মীয়, স্বীয়, অন্য, সদৃশ্য, ব্যবধায়ক, অন্তকরণ, পরমাত্মা ইত্যাদি।
কিন্তু বাংলায় অন্তর মানে বাহির (ধেকা মারি করিব তোরে পুরির অন্তর - মীনচেতন)।
বাংলায় ক্রিয়া-বিশেষণ হিসেবে অন্তর শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। হরিচরণ বন্ধ্যোপাধ্যায় মতে, এ অন্তরের মূল সংস্কৃত 'অনন্তর'। অর্থাৎ বাংলা ক্রিয়া-বিশেষণ অন্ত মানে পরে (দশ দিন অন্তর রাজার দশা করিল গোচর - গোপীচন্দ্র)। আর অন্তরে মানে পরে (ইহার অন্তরে তবে শুন সর্বজনে - কাশীদাসী মহাভারত)। এই পরে বা অন্তে ভাবধারায় বাংলায় বিবাহঅন্তরে, মাসান্তরে, পঞ্চাদিনান্তরে, সন্ধ্যাধূপ-অন্তরে শব্দের প্রয়োগ রয়েছে (দেখুন, হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষ)।
বাংলায় বিশেষ্য হিসেবে অন্তর মানে মন (অন্তরমম বিকশিত কর অন্তরতর হে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; প্রতারণাহীনা তবু সমূহ সুন্দর/শীর্ণকায়া স্রোতস্বিনী শোধিত অন্তর - মুহাম্মদ নুরুল হুদা), ভেতর (তিনি এখন ঘরের অন্তরে), পার্থক্য (বড় সাহেবের সাথে মেজ সাহেবের মতান্তর চলছে), তফাত (কিঞ্চিৎ অন্তরে কিঙ্করকে দেখিতে পাইয়া - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর), অবসান (শিশুতা অন্তরে হৈল যৌবন বিস্তার - ভবানন্দ), আত্মীয় (অন্তরতম হে সুন্দর)।
অন্যদিকে বিশেষণে অন্তর মানে ভিন্ন, অন্য (অবশেষে সে দেশান্তরে গেল)।
শব্দের পোস্টমর্টেম-১০৯
বাংলায় কারারুদ্ধ অর্থে অন্তরীণ শব্দটি বেশ চালু এবং চালু হয়ে যাওয়ার কারণেই এটাকে আর অশুব্দ বলা যায় না। অথচ শব্দটি আভ্যন্তরীণ শব্দের সাদৃশ্যে অশুদ্ধভাবে তৈরি।
অন্তরীণ শব্দটি সংস্কৃত নয়। তাই সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মও শব্দটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অর্থ্যাৎ শব্দটিতে দীর্ঘ-ঈ কার যেমন খাটে না, তেমনি মূর্ধণ্যের প্রয়োগও বাড়াবাড়ি। তারপরও শব্দটি রমরমিয়ে চলছে।
অন্তরীণ শব্দটি বাংলা এবং কেউ কেউ মনে করেন, এটার শুদ্ধ রূপ হওয়া দরকার 'অন্তরিন'। অন্তরিত শব্দটিকেও একই অর্থে প্রয়োগ করা যায়। একই কায়দায় কারারুদ্ধ বা বন্দিত্ব অর্থে 'অন্তরন' শব্দটি বেশ যুক্তিযুক্ত। কারণ অন্তরন বাংলা মতে গঠিত। তাই অন্তরণ শব্দটি খাটবে না।
তবে এক সময় অন্তরীণ শব্দের অর্থ ছিল অন্তরঙ্গ, অতিপ্রিয়। চৈতন্য চরিতামৃতে তার সাক্ষ রয়েছে (সর্বতত্ত্ব জানে সে প্রভুর অন্তরীণ)। অন্তরীণের এই অর্থ এখন আর খাটবে না।
শব্দের পোস্টমর্টেম-১১0
অন্তর্ভুক্ত শব্দটিকে কেউ কেউ 'অন্তর্ভূক্ত' লিখেন, যা মোটেও শুদ্ধ নয়। আবার শব্দটি সংস্কৃত নয়, বাংলা। অন্তর্গত বা অন্তর্ভূত অর্থে বাংলায় এটি প্রচলিত। শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে এভাবে : অন্তর্ + ভুজ + ত।
সংস্কৃত 'ভুক্ত' শব্দের বাংলা অর্থ অধিকৃত, অন্তর্গত, দখলিত। আবার সংস্তৃত 'ভুক্তি' (ভুজ্ + তি) শব্দের বাংলা একটি অর্থ হচ্ছে 'অধিকারস্থিত'।
অন্তর্ভুক্ত শব্দের ব্যাখ্যায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন চুপ ছিলেন, তেমনি রাজশেখর বসুও তাঁর চলন্তিকা অভিধানে শব্দটির কোনো ব্যাখ্যা দেননি। বরং তারা অন্তর্গত ও অন্তর্ভূত শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তবে রাজশেখর বসুর লেখায় অন্তর্ভুক্ত শব্দটি ঠিকই আছে (অসংখ্য সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে - বাংলা ভাষার গতি)।
সুকুমার সেনও শব্দটি ব্যবহার করেছেন (সুতরাং হঠাৎ মনে হওয়া অসম্ভব নয় যে, কোনো রামকথা কাব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল শ্লোক দুটি - রামকথার প্রাক ইতিহাস)।
আবার বুদ্ধদেব বসু 'অন্তর্ভূত' শব্দের পক্ষপাতী ছিলেন (আধুনিক কালের সব কবিকেই দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভূত বলা যায় - কালিদাসের মেঘদূত)।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'অন্তর্ভুক্ত' শব্দটি শুধু মেনেই নেননি, তিনি শব্দটির বিপরীত হিসেবে 'বহির্ভুক্ত' শব্দটিও চালু করে গেছেন (আজ আমরা সমাজের সমস্ত কর্তব্য নিজের চেষ্টায় একে একে বহির্ভুক্ত স্টেটের হাতে তুলিয়া দিবার জন্য উদ্যত হইয়াছি - স্বদেশী সমাজ)
শব্দের পোস্টমর্টেম-১১১
অপরম্ভা সংস্কৃত শ্লোকের একটি শব্দ। এটির অর্থ 'এছাড়া আর কিবা'। : 'ভোজনং যত্র তত্র চ শয়নং হট্টমন্দিরে। মরণং গোমতী তীরে কিং ভবিষ্যতে'। 'যেখানে সেখানে ভোজন, হট্টমন্দিরে (হাটচালায়) শয়ন, আর গোবাগাড়ে মরণ, এছাড়া আরও বা কি কপালে আছে।'
এ শ্লোকের মূল গল্প এরকম : সাধারণের বিশ্বাস, নরকপালের সন্ধি স্থলে যে বক্ররেখা থাকে, তা বিধাতার ভাগ্যলিপি। এক ব্রাহ্মণ এক কপালের লিপিতে ওই শ্লোক দেখে 'আরও বা কি ভাগ্যে আছে?' - তা পরীক্ষা করতে ঘরে এনে লুকিয়ে রাখলেন। একদিন ব্রাহ্মণ পত্নী তা দেখতে পেলেন। তার মনে সন্দেহ হল, এটা নিশ্চয় স্বামীর কোনো গোপন প্রণয়ীর কপাল। প্রণয় ভুলতে না পেরে ঘরে এনে লুকিয়ে রেখেছে। ব্রাহ্মণ পত্নী তা ঢেঁকিতে চুর্ণ করে বিষ্ঠাময় স্থানে ফেলে দিলেন।
ব্রাহ্মণ ঘরে ফিরে কপাল দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করায় ব্রাহ্মণ পত্নী তেলে-বেগুনে জলে উঠে মনের ধারণার কথা বলে ফেললেন। ব্রাহ্মণ তখন শ্লোকের শেষ লাইনের অর্থ কার্যত প্রত্যক্ষ করে হাসতে হাসতে ওই ভাগ্যলিপির আবৃত্তি ও অর্থ ব্যক্ত করে নিজের অভিপ্রায়ের কথা স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিলেন।
এটাই অপরম্ভা শব্দের পেছনের কাহিনী।
শব্দের পোস্টমর্টেম-১১২
ব্যাকরণ অনুযায়ী অপরূপ শব্দের অর্থ 'কুরূপ' বা বাজে রূপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। অথচ শব্দটি সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থেই বাংলা ভাষায় বেশ দাপটের সঙ্গেই চলছে। সুভাষ ভট্টাচার্য তাঁর 'বাংলা প্রয়োগ অভিধান'-এ অপরূপ শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, 'শব্দটি তৎসম নয়। দুটি অর্থ এর। প্রথম অর্থ অতুলনীয় সৌন্দয্যবিশিষ্ট বা অপূর্ব। দ্বিতীয় অর্থ একেবারেই ভিন্ন, কিম্ভূত, অদ্ভুত। প্রথম অর্থে শব্দটি প্রাকৃত 'অপরুব' থেকে এসে থাকতে পারে। দ্বিতীয় অর্থে অপ (অপগত) + রূপ - এরকম একটা উৎস ভাবা যেতে পারে।'
সংস্কৃত পণ্ডিত পরেশচন্দ্র মণ্ডল কুরূপ অর্থে অপরূপ শব্দের ব্যাখ্যা মানেন নি। তিনি তাঁর 'ভাষাবিদ্যা পরিচয়' গ্রন্থে দাবি করেছেন, 'অপূর্ব শব্দ থেকেই অপরূপ শব্দটি এসেছে'। : অপূর্ব > অপুরব (স্বরভক্তি হেতু) > (লোকনিরুক্তি হেতু) অপরূপ ।।